নেত্রকোণার দর্শনীয় স্থান

নেত্রকোণা যেন প্রকৃতির জলরঙে আঁকা এক ছবি। এখানে আছে বিজয়পুরের চিনামাটির পাহাড়, হাওরজলভরা খালিয়াজুরী মদন, মোহনগঞ্জ, আছে পাঁচগাঁও পাহাড় আর পাহাড়ি গারো সম্প্রদায়ের ছায়াঘেরা গ্রাম। এই পর্বে আমরা ঘুরে দেখবো নেত্রকোণার দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ - যা শুধু দেখার জন্য নয়, অনুভব করার জন্যও।

বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়
দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুরে অবস্থিত চীনামাটির পাহাড় ও নীল জলাধার নেত্রকোণার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এই অঞ্চলের সাদা চীনামাটি এবং নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বিজয়পুরের চীনামাটি বাংলাদেশের একটি ভূ-ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। 

সোমেশ্বরী নদী 
সোমেশ্বরী নদী দুর্গাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি স্বচ্ছ ও শান্ত নদী। এই নদীর তীরে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নদীর পাড়ে নৌকা ভ্রমণ ও পিকনিকের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি 
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, যা স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করে। এখানে একটি জাদুঘর রয়েছে, যেখানে গারো, হাজং ও অন্যান্য আদিবাসীদের জীবনধারা ও শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। 

কমলা রাণীর দিঘী 
কমলা রাণীর দিঘী একটি ঐতিহাসিক দিঘী, যা দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি এলাকায় অবস্থিত। এই দিঘীর সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি ও ইতিহাস জড়িত, যা স্থানীয়দের কাছে সমাদৃত।

টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ 
টংক শহীদ স্মৃতি সৌধ দুর্গাপুর উপজেলার এমকেসিএম সরকারি হাই স্কুল সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এটি টংক আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

রাণীখং মিশন 
রাণীখং মিশন দুর্গাপুর উপজেলার একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা স্থানীয় গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবস্থিত, যা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।

রাশমণি স্মৃতি সৌধ
টংক আন্দোলনের নেত্রী রাশমণি হাজং স্মরণে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস বহন করে। ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৬ সালে জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘রাশমণি দিবস’ ও ‘টংক শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এটি বহেরাতলী, দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত।

রোয়াইলবাড়ি দুর্গ  
কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত রোয়াইলবাড়ি দুর্গ একটি প্রাচীন দুর্গ, যা মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতিহাসপ্রেমীদের আকর্ষণ করে।

ডিঙ্গাপোতা হাওর
ডিঙ্গাপোতা হাওর নেত্রকোণা জেলার একটি বৃহৎ হাওর, যা বর্ষাকালে জলরাশির সৌন্দর্যে ভরপুর থাকে। শীতকালে এটি পরিণত হয় সবুজ ধানের মাঠে, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে।

পাঁচগাঁও
পাহাড়ি সীমান্তঘেঁষা পাঁচগাঁও এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। রংছাতি ইউনিয়ন, কলমাকান্দার এই স্থানে দেখা মেলে সবুজ টিলা, গারো ও হাজং আদিবাসীদের জীবনধারা, এবং গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বিস্তার। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এখানেই শুরু হয়েছে গারো পাহাড়ের বাংলাদেশ অংশ। এর সঙ্গে চন্দ্রডিঙ্গার ঐতিহাসিকতা একত্রে এই স্থানকে করে তুলেছে অনন্য।

চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড় কলমাকান্দা উপজেলার এক অপার সৌন্দর্য। লোককথা অনুযায়ী, চাঁদ সওদাগরের নৌকা এখানে ডুবে গিয়েছিল বলেই পাহাড়টির আকৃতি নৌকার মতো। এখানকার ছোট ঝর্ণা ও ঝিরিপথ বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায় এবং শীতে দেয় শান্তি আর নির্জনতা। প্রকৃতিপ্রেমী এবং ট্রেকারদের জন্য এটি এক আদর্শ স্থান।

কবি নির্মলেন্দু গুণের কাশবন 
বারহাট্টা উপজেলার কাশতলা গ্রামে কবি নির্মলেন্দু গুণের নিজ হাতে গড়া সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র "রামসুন্দর পাঠাগার", "বীণা-পানি সংগ্রহশালা", ও "বীরচরণ মঞ্চ" সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানে কবির প্রাপ্ত পুরস্কার ও বঙ্গবন্ধুর কাঠের ভাস্কর্য সংরক্ষিত রয়েছে।

শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক একাডেমি
বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মরণে নির্মিত এই সাংস্কৃতিক একাডেমি নেত্রকোণার অন্যতম গর্ব। বাহাম, মোহনগঞ্জ উপজেলার শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক একাডেমিতে রয়েছে নাট্য মঞ্চ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং রবীন্দ্রসংগীতের ঐতিহ্যবাহী চর্চা কেন্দ্র। শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী আয়োজন করেছিলেন এই নেত্রকোনার মানুষই।

রাজধলা বিল
পূর্বধলা উপজেলার এই ঐতিহাসিক বিলের নামকরণেই লুকিয়ে আছে জমিদার শাসনের এক বিশেষ অধ্যায়। স্থানীয় ঘাগড়া জমিদারদের কৌলিন্য রক্ষার কাহিনি ও প্রজাদের উপর শোষণ—সব মিলে এই বিলে জমেছে ইতিহাস ও পরিবেশের মেলবন্ধন। এখনো বিলটি ‘রাজধলা বিল’ নামেই পরিচিত। বর্ষাকালে এই বিলের সৌন্দর্য অতুলনীয়।

সুনাইকান্দা প্রাচীন জামে মসজিদ
প্রায় ৪০০ বছর আগে নির্মিত এই ঐতিহাসিক মসজিদটি পূর্বধলা উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের সুনাইকান্দা গ্রামে অবস্থিত। ৮২ শতাংশ ভূমির উপর দাঁড়ানো এই মসজিদটি কারুকার্যে অতুলনীয় এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। 

হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রহ.) এর মাজার 
নেত্রকোণা সদর উপজেলার মদনপুর গ্রামে অবস্থিত হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রহ.) এর মাজার একটি ধর্মীয় স্থান। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। 

কবিতাকুঞ্জ 
নেত্রকোণা সদরের মালনী এলাকায় মগরা নদীর তীরে অবস্থিত কবিতাকুঞ্জ কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রতিষ্ঠিত একটি কবিতা পাঠাগার। এখানে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত কবিদের কবিতার সংকলন রয়েছে, যা সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। 

গোবিন্দ চাতাল পদ্মবিল
নেত্রকোণা শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিল পদ্ম ফুলের অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত করে পর্যটকদের। সাত গ্রামের উপর বিস্তৃত এই বিল যেন এক প্রাকৃতিক পদ্ম উদ্যান। বর্ষাকালে ও শরতে পদ্ম ফুল ফোটে, যা দর্শনার্থীদের মন কাড়ে।

নানিয়াপাড়া কেগাতী শাপলাবিল
প্রায় ১০০ একর জায়গাজুড়ে ফুটে থাকা শাপলা ফুল, শান্ত পানির ওপর নৌকা ভ্রমণ, আর প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা—এই বিল যেন প্রকৃতির আরেকটি স্বর্গীয় উপহার। স্থানীয় ও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই শাপলা বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

উচিতপুর হাওর
‘মিনি কক্সবাজার’ নামে খ্যাত উচিতপুর হাওর এখন নেত্রকোণা মদন উপজেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থলগুলোর একটি। বর্ষাকালে জলে ডুবে থাকা পিচঢালা রাস্তা, হাওরের ঢেউ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, আর দ্বীপের মতো গ্রামগুলো মিলে এটি এক অভাবনীয় প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা দেয়।

নবীনতর পূর্বতন