বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁ: মরমি সাধনা ও চেতনার কবি


ভূমিকা

বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে এক অনন্য নাম জালাল উদ্দিন খাঁ। তিনি ছিলেন একাধারে বাউল সাধক, সংগীতশিল্পী, মরমি কবি ও আধ্যাত্মিক চিন্তক। তাঁর গান এবং সাধনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মানুষের চেতনা, সমাজবোধ এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান।

জন্ম ও জন্মস্থান

জালাল উদ্দিন খাঁ ১৩০৫ বঙ্গাব্দে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়ার সিংহের গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সদর উদ্দীন খাঁ। তাঁর পূর্বপুরুষ শচীন্দ্রনাথ শর্মা ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ যাজক, যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতান খাঁ নাম ধারণ করেন।

শিক্ষা জীবন

শৈশবে গ্রামের পাঠশালা এবং নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। পরে কেন্দুয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে স্কুল ত্যাগ করেন এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে।

কর্মজীবন

১৯৩০ সালে স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি সংসার ত্যাগ করে বিভিন্ন মাজার ও পীরের আস্তানায় ঘুরে বেড়ান। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের সুফি সাধক সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস পীরের সান্নিধ্যে এসে বাউল জীবনে প্রবেশ করেন এবং একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

অবদান

আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’ জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নামগুলো হলো- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

শিল্পকলায় (সংগীত) অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন।

মৃত্যু

১৯৭২ সনে ৩১ জুলাই বাংলা ১৬ই শ্রাবণ, ১৩৭৯ দুই পুত্র তিন কন্যা, এবং স্ত্রী শামছুন্নাহার বেগমকে রেখে দেহত্যাগ করেন। নিজ গ্রামের বাড়ীর আঙ্গিনায় তার মাজার অবস্থিত।

উপসংহার

জালাল উদ্দিন খাঁ ছিলেন বাংলার বাউল ধারার এক অমর শিল্পী। তাঁর সাধনা, গান ও চিন্তাধারা লোকজ সংস্কৃতির ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি আমাদের কণ্ঠে, চিন্তায় ও চেতনায় আজও বেঁচে আছেন।

উৎস ও বিস্তারিত:

নেত্রকোণা মুখশ্রী, কাজী ইমদাদুল হক সম্পাদিত, প্রকাশক নেত্রকোণা জেলা সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা, প্রকাশকাল মার্চ ২০০৫
ময়মনসিংহের চরিতাভিধান, দরজি আবদুল ওয়াহাব, প্রকাশক গ্রন্থকার, ময়মনসিংহ, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৮৯ কালি ও কলম - মরমি কবি জালাল উদ্দীন খাঁ - বিস্তারিত উইকিপিডিয়া - বিস্তারিত

নবীনতর পূর্বতন