কাহ্নপা: চর্যাপদের কবি ও সহজিয়াচার্যের সিদ্ধস্বরূপ

 


ভূমিকা

কাহ্নপা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আদি কবি, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক এবং সিদ্ধাচার্য। তিনি চর্যাপদের অন্যতম ও সর্বাধিক পদরচয়িতা, যিনি ভাষা, বোধ ও সাধনার যুগল মিলনে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি শক্তিশালী ধারা নির্মাণ করেন।

জন্ম ও পরিচয়

তাঁর জন্ম আনুমানিক ১০ম শতকে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার কৃষ্টপুর গ্রামে। প্রকৃত নাম কৃষ্ণাচার্য পাদ; অপভ্রংশে পরিচিতি পান কাহ্নপা, কনহপা, কাহিল পা নামেও। যদিও কেউ কেউ তাঁকে উড়িষ্যার অধিবাসী বলে মনে করেন, জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া তাঁর নেত্রকোণাবাসী পরিচয়কে ভাষা ও শব্দচর্চার ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন।

জীবন ও সাধনা

তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয়, কিন্তু পরবর্তীতে সহজিয়া মতে দীক্ষা গ্রহণ করে সিদ্ধাচার্য হন। গুরু ছিলেন নাথপন্থী যোগী জলন্ধরী পা (হাড়িপা)। পরিণত বয়সে সোমপুর মহাবিহারে (বর্তমান পাহাড়পুর) অবস্থান করেন এবং সেখানকার প্রধান আচার্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

সাহিত্য ও সঙ্গীত

কাহ্নপা চর্যাপদের ২৩ কবির মধ্যে সর্বাধিক ১৩টি পদ রচনা করেন। তাঁর রচনায় বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের একত্র প্রভাব পাওয়া যায়। প্রতিটি পদে রাগ-তাল নির্দেশ রয়েছে, যা তাঁর সঙ্গীতজ্ঞান ও রচনাশৈলীর প্রমাণ।

তাঁর নামাঙ্কিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • কাহ্নপাদগীতিকা
  • যোগরত্নমালা
  • হেবজ্রসাধন
  • তত্ত্বোদ্যোৎকার
  • হেবজ্রপদ্ধতি
  • মণ্ডলবিধি

অপভ্রংশ ভাষায় লিখিত ‘দোহাকোষ’ তাঁর রচনার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। তাঁর রচিত “হেবজ্রপঞ্জিকা” নামক পুঁথি সংরক্ষিত আছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।

দর্শন ও কাব্যভাবনা

রূপক-প্রতীক-সংকেতনির্ভর কাব্যভাষা, সহজতত্ত্বের বর্ণনা ও আত্মজিজ্ঞাসায় কাহ্নপার রচনায় এক অনন্য দর্শন উঠে আসে। কবিত্ব, সাধনা ও ভাষাগত বুদ্ধিমত্তার মেলবন্ধনে তিনি বাংলা সাহিত্যের আদি গৌরব।

উপসংহার

কাহ্নপা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শুধু একজন কবি নন, বরং সাধক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক। নেত্রকোণার কৃষ্টপুর তাঁর জন্মস্থান হিসেবে এই অঞ্চলের ইতিহাসে এক গৌরবময় চিহ্ন বহন করে।

উৎস নির্দেশ

নেত্রকোণা মুখশ্রী, জেলা সমন্বয় পরিষদ

সহায়ক গ্রন্থ: নেত্রকোণা জেলা চরিতকোষ – অনুপ সাদি ও দোলন প্রভা – ২০২৪

নবীনতর পূর্বতন