উকিল মুনশি: বিরহী বাউলের অন্তর্লীন আর্তনাদ


ভূমিকা

উকিল মুনশি ছিলেন একজন বিরহী বাউল সাধক, যিনি একইসঙ্গে ইমাম ও গায়ক হিসেবে ভাটি বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। একতারা হাতে তার আর্তনাদ, তার মোনাজাত, এবং তার বিরহভরা কণ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষের আত্মার স্পর্শ।

জন্ম ও নামকরণ

১১ জুন ১৮৮৫ সালে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ির নূরপুর বোয়ালী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল হক আকন্দ, ডাক নাম ‘উকিল’। পিতার নাম গোলাম রসূল আকন্দ। ইমামতির কারণে তিনি পরিচিতি পান ‘মুনশি’ উপাধিতে, যা পরবর্তীতে ‘উকিল মুনশি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রেম ও বিয়ে

মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে। পরে তিনি জালালপুর গ্রামে চাচার বাড়িতে আসেন এবং স্থানীয় কৃষক লবু হোসেনের কন্যা ‘লাবুশের মা’-এর প্রেমে পড়েন। প্রেম নিয়ে রচনা করেন প্রসিদ্ধ গান – “ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে/সোনার জালালপুর, সেইখানেতে বসত করে/উকিলেরই মনচোর”। কাজী বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও গোপনে বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে।

ইমামতি ও সঙ্গীতচর্চা

বরান্তর মসজিদে ইমামতি করার পাশাপাশি তিনি সারারাত গজল গাইতেন। বিয়ের পর একতারা হাতে গান করা শুরু করেন এবং হবিগঞ্জের পীর মোজাফফর আহম্মদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শরিয়তপন্থী এই সাধক একতারা ও চেটিয়া ছাড়া অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন না।

বাউল সাধনা ও জনপ্রিয়তা

তার গানে ছিল বিরহ, তত্ত্ব ও প্রেমধর্ম। 'আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি' গানটি হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় ব্যবহার হয়ে নতুন প্রজন্মের কাছেও পরিচিতি পায়। শত শত গান রচনা করেছেন; একটি বই প্রকাশিত হলেও বর্তমানে তার অনেক গানের আর খোঁজ মেলে না।

ধর্মীয় ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা

তিনি ছিলেন ইমাম এবং বাউল – এই বিরল সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক। জানাজার নামাজ, মাহফিলে মোনাজাত এবং গান – সব ক্ষেত্রেই মানুষ তাকে চাইত। কখনো গান থামিয়ে জানাজা পড়াতে গেছেন, আবার কখনো মোনাজাতে কাঁদিয়ে দিয়েছেন পুরো জামাত।

মৃত্যু

১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর, পুত্র আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর কিছুদিন পর, পুত্রশোকে তিনি নিজেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উপসংহার

উকিল মুনশি ছিলেন এক বিরল মরমী চরিত্র। তার জীবন ছিল প্রেম, বিরহ, ধর্ম আর মানুষের জন্য নিবেদনের এক অনন্য সুর। তার জীবনগাথা আজও ভাটি বাংলার মানুষের কণ্ঠে জাগে।

উৎস নির্দেশ

[বাউ] বাংলা উইকিপিডিয়া | [নেমু] নেত্রকোণা মুখশ্রী | [মচ] ময়মনসিংহের চরিতাভিধান

সহায়ক গ্রন্থ: নেত্রকোণা জেলা চরিতকোষ – অনুপ সাদি ও দোলন প্রভা – ২০২৪


নবীনতর পূর্বতন