কুমুদিনী হাজং: আদিবাসী নারী জাগরণ ও টংক আন্দোলনের অগ্রদূত


ভূমিকা

টংক ও তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাসে কুমুদিনী হাজং এক সংগ্রামী নারী প্রতীক, যিনি নেত্রকোণার দুর্গাপুর থেকে আদিবাসী নারীর নেতৃত্বকে তুলে ধরেছিলেন দুর্বার সাহসে। তাঁর সংগ্রাম শুধুই একক নয়, বরং ছিল জাতিগত অধিকার, নারীর মর্যাদা ও ভূমির স্বত্ব রক্ষার লড়াই।

জন্ম ও শৈশব

কুমুদিনী হাজং-এর জন্ম ১৯৩০ সালে নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বহেরাতলী গ্রামে। পিতা অতিথচন্দ্র হাজং ও মাতা জানমনি হাজং। পিতা ছিলেন ‘হাতিখেদা বিদ্রোহে’ অংশগ্রহণকারী একজন সাহসী হাজং। জন্মের দুই বছরের মধ্যেই মা-বাবা মারা যান। মামার বাড়িতে বড় হন, তবে মামার নাম তার মনে নেই কারণ কেউ তাকে নাম ধরে ডাকতো না।

শিক্ষা

তৎকালীন সময়ে দুর্গাপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় কুমুদিনী হাজং কখনোই স্কুলে যেতে পারেননি।

হাজং সম্প্রদায় ও টংক প্রথা

হাজংরা তখন কৃষিকাজে নিয়োজিত এক নির্যাতিত জাতি ছিল। জমিদার-মহাজনদের শোষণমূলক ‘টংক প্রথা’ অনুসারে ফসল হোক বা না হোক—চুক্তিভিত্তিক ধান দিতে হতো। এই ফাঁদে পড়ে হাজংরা ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল।

আন্দোলনে সম্পৃক্ততা

১৯৩৭ সালে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে হাজংরাও তাতে অংশ নেয়। কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং এবং তাঁর ভাইয়েরা ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। গোটা পরিবার মনি সিংহের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

বহেরাতলীর হামলা ও রাশিমনি হাজং-এর শহীদ হওয়া

১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকালে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দল বহেরাতলীতে হানা দেয়। লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের গ্রেপ্তার করতে না পেরে, কুমুদিনী হাজংকে সশস্ত্র ক্যাম্পে নিতে চায়। তিনি "জানি না" বলায় সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়।

খবর পেয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে হাজং নারী-পুরুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নারী নেত্রী রাশিমনি হাজংসহ ১২ জন মহিলা কুমুদিনীকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে সেনারা গুলি চালায়, রাশিমনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজংকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর হাজংরা বল্লম ও রামদা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে—দুইজন সেনা নিহত হয়।

আত্মগোপন ও নাম পরিবর্তন

সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে গ্রামবাসীরা আড়াপাড়ার গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়। পরে তিনি আত্মগোপন করেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে বলেশ্বর হাজং-এর বাড়িতে। সেখানে তাঁর নাম পরিবর্তন করে 'সরস্বতী' রাখা হয় যেন কেউ চিনতে না পারে।

মামলা ও পুলিশী নির্যাতন

ঘটনার পর সরকার কুমুদিনী হাজং, লংকেশ্বর হাজং, কমরেড মনি সিংহসহ অনেককে আসামি করে হত্যা মামলা করে। পুলিশের অত্যাচারে অনেক হাজং পরিবার গৃহহীন ও ফেরারি হয়ে পড়ে।

কুমুদিনী হাজং-এর প্রভাব ও সম্মান

রাশিমনি হাজং-এর আত্মত্যাগ ও কুমুদিনী হাজং-এর প্রতিরোধ হাজং নারী সমাজে সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে ওঠে। রাশিমনি ‘হাজং মাতা’ হিসেবে খ্যাতি পান, আর কুমুদিনী হাজং ‘আদিবাসী নারী জাগরণের’ প্রতীক হয়ে যান।

মৃত্যু

২৩ মার্চ ২০২৪ সালে কুমুদিনী হাজং মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনের ইতিহাস প্রমাণ করে—সংগ্রামী নারীর কণ্ঠ কখনো হারায় না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হয়ে ওঠে আলোকবর্তিকা।

উৎস নির্দেশ

[নেমু] নেত্রকোণা মুখশ্রী [নেজেই] নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস

সহায়ক গ্রন্থ: নেত্রকোণা জেলা চরিতকোষ – অনুপ সাদি ও দোলন প্রভা – ২০২৪

লেবেল:

নারীনেত্রী, আন্দোলনকারী, সমাজসেবক, আদিবাসী, দুর্গাপুর, টংকআন্দোলন

নবীনতর পূর্বতন