কর্নেল আবু তাহের: পূর্বধলার বিপ্লবী সৈনিক ও গণআন্দোলনের নায়ক

 


ভূমিকা

কর্নেল আবু তাহের ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সামরিক কর্মকর্তা এবং এক সংগ্রামী রাজনীতিবিদ। সাহস, আদর্শ এবং জনগণের পক্ষে অবস্থানের জন্য তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

জন্ম ও শৈশব

১৪ নভেম্বর ১৯৩৮ সালে নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কর্নেল আবু তাহের। তাঁর জন্ম হয় আসামের বদরপুরে, তাঁর নানার বাড়িতে। পিতার নাম মহীউদ্দিন আহমেদ, মাতার নাম আশরাফুন্নেসা। ডাক নাম ছিল ‘নান্টু’। শৈশব কেটেছে আসামের গহীন অরণ্যময় এলাকায়।

শিক্ষা ও রাজনৈতিক প্রভাব

তাহের ফতেহবাদ স্কুলে পড়াশোনা করেন, যেখানে অনেক শিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সূর্য সেনের সহযোগী। এই শিক্ষকদের প্রভাবে তাহেরের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়।

১৯৫৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন কুমিল্লা থেকে এবং ১৯৫৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর কিছুদিন চট্টগ্রামের দুর্গাপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এমএ প্রোগ্রামে, তবে সে অধ্যয়ন অসমাপ্ত রেখে তিনি ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

সামরিক ক্যারিয়ার

  • ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ
  • কমান্ডো বাহিনীতে বদলি হন এবং চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেন
  • ফোর্ট ব্রাগ ও ফোর্ট বেনিং, যুক্তরাষ্ট্রে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন
  • ১৯৭০ সালে কোয়েটা স্টাফ কলেজে সিনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্সে অংশগ্রহণ
  • ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রতিবাদে স্টাফ কলেজ ত্যাগ করেন

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালে কামালপুর আক্রমণের সময় তিনি গুরুতর আহত হন এবং হাঁটুর ওপরে থেকে তার বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন

ভারতে চিকিৎসা শেষে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং পরে জুন মাসে ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক হন। তিনি ব্যারাক আর্মির পরিবর্তে ‘পিপলস আর্মি’ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

রাজনীতি ও ৭ নভেম্বর

১৯৭২ সালের অক্টোবরে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেন এবং দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সহ-সভাপতি হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি সিপাহী ও জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।

গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ড

২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কর্নেল তাহের গ্রেপ্তার হন। কারাগারে সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

উপসংহার

কর্নেল আবু তাহের ছিলেন একজন দূরদর্শী ও আদর্শবাদী সংগ্রামী। তাঁর জীবন বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে।

উৎস নির্দেশ

নেত্রকোণা মুখশ্রী, জেলা সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা, ২০০৫

নবীনতর পূর্বতন